ঢাকা | বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২

বাজেটে অর্থপাচারকারীদের ‘সুযোগ’ কেন, যা বললেন মন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ১১ জুন ২০২২ ১০:৩৪

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল

দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ বিনা প্রশ্নে ফেরত আনতে প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান সংযোজনের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গতকাল (বৃহস্পতিবার) ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছেন। 

জানা গেছে, বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরাতে বিশেষ ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তাই আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রথমবারের মতো পাচারকারীদের ট্যাক্স অ্যামনেস্টি (আয়কর দিলে দণ্ড মাফ) সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ পন্থায় কেউ অর্থ ফেরত আনলে দেশের অন্য কোনো আইনেও এ নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না। এক্ষেত্রে পরিশোধ করতে হবে নির্ধারিত কর। এ সুবিধা এক বছরের জন্য দেওয়া হচ্ছে।

পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরাতে সরকারের এই ‘সুযোগ’কে নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রেণিপেশার মানুষ, অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি সংস্থা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ সমাবেশে বলেছেন, ‘পাচার করা অর্থ ফেরাতে দায়মুক্তিই প্রমাণ করে প্রস্তাবিত বাজেট সাধারণ মানুষের জন্য নয়। বাজেটে কাদেরকে সাহায্য করেছে? যারা টাকা চুরি করল, ডাকাতি করল, লুণ্ঠন করল এবং লুণ্ঠন করে বিদেশে টাকা পাচার করল পিকে হালদারের মতো লোকদের। তারা এখন ৭% ট্যাক্স দিলে বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনতে পারবে এবং এর বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। তাদেরকে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) ধরবে না, হাইকোর্ট থেকেও তাদেরকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি পুরোপুরি অসাংবিধানিক, সংশ্লিষ্ট আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক বলে মন্তব্য করেছে। সংস্থাটি বলছে, এই সুযোগ অর্থপাচার তথা সার্বিকভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে, যা সংবিধান পরিপন্থী এবং প্রধানমন্ত্রীর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুন্য সহনশীলতা’ ঘোষণার অবমাননাকর।

অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থপাচারকারীদের জয় হয়েছে।এ সুযোগ খুব একটা কাজে আসবে না। বরং ভবিষ্যতে টাকা আরও পাচার হওয়ার প্রবণতা তৈরি হবে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ সময়ে কেউ টাকা দেশে ফেরত আনবে না।

শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এসব মন্তব্যের জবাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সবদিক বিবেচনা করেই আমরা এবার এ সুযোগ দিয়েছি। শুধু ঘুস ও দুর্নীতির টাকা নয়, সিস্টেমের কারণেও অনেক টাকা অপ্রদর্শিত হয়ে যায়। বাংলাদেশ শুধু নয়, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৭টি দেশ এ সুযোগ দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এক্ষেত্রে আমরা সফল হবো।

রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে দুপুর ৩টায় এ সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। গতানুগতিক প্রতিবছর বাজেটের পরদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন অর্থমন্ত্রী। গত দুই বছর হয়নি করোনা ভাইরাসের কারণে। এ বছর তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম প্রস্তাবিত বাজেটকে সংকোচনমূলক বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, সরকারের ব্যয় মানেই হচ্ছে জনগণের আয়। আয় বাড়লে চাহিদা বেড়ে যায়। বর্ধিত চাহিদা না আসে এজন্য এবারের বাজেট সংকুচিত রাখা হয়েছে।

এবার সংবাদ সম্মেলনে অধিকাংশ প্রশ্নই ছিল পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা প্রসঙ্গে। এ বিষয়ে একাধিক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ এই সুযোগ দিয়েছে। আইন সংশোধন করে একটি ঘোষণা দিয়ে ২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়া ৯৬০ কোটি মার্কিন ডলার ফেরত নিয়ে আসছে। আমরা প্রশ্ন করব না, কারণ টাকাগুলো বিভিন্ন কারণে বিদেশ চলে যেতে পারে। সব টাকা কালো টাকা নয়। কিছু টাকা বিভিন্ন কারণেই কালো হয়ে যায়। এসব দিক বিবেচনা করেই আমরা এবার এ সুযোগ দিয়েছি। 

অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, টাকার একটি ধর্ম আছে। টাকা যেখানে সুখ বিলাস পায় সেখানে চলে যায়। স্যুটকেসে করে কেউ টাকা পাচার করে না। ডিজিটালাইজেশন যুগে অনেক টুলস আছে পাচারের জন্য। দায়িত্ব নিয়ে বলছি জামানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে এই সুযোগ দিয়েছে। টাকা পাচার হয়নি সেটি বলি না। কিন্তু যেভাবে বলা হচ্ছে সেভাবে টাকা পাচার হয়নি। তবে এই পাচারের সঙ্গে যারা যুক্ত দেশের ভেতর অভিযুক্ত অনেকের বিচার হচ্ছে। সরকার নীরব থেকে বসে নেই। পাচারকৃত টাকা এ দেশের মানুষের হক। এখানে বাধা দেইনি। বাধা দিলে টাকা আসবে না। 

পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত না এলে আমাদের লাভ কী। গত দুই বছরে ১৭টি দেশ এই উদ্যোগ নিয়েছে টাকা ফেরত আনার। আমেরিকাও করেছে। মালয়েশিয়াও করেছে। আশা করি এ উদ্যোগ নিলে আমরা সফল হবো। এতে করে যারা কর দিচ্ছে তাদের সম্মান ক্ষুন্ন হবে না।

পিকে হালদারের টাকা পাচার প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, যেটি প্রমাণ করা যায় না। সেটি কীভাবে ফেরত আনা যাবে। অনেকে বলে সুইজারল্যান্ডে ব্যাংকে টাকা আছে। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। একটি ভালো দিক আছে। পৃথিবী এখন একীভূত হচ্ছে। মন্দকাজগুলো দূরে রাখার চেষ্টা করছে। 

তিনি বলেন, পিকে হালদার ভালো অবস্থায় নেই। ভারত সরকার স্বীকার করেছে পিকে হালদারের পাচারকৃত টাকা ফেরত দেবে এবং পিকে হালদারকেও ফেরত দেবে। কানাডার সরকারও স্বীকার করেছে পিকে হালদারের টাকা ফেরত দেবে। 

অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি- এখনই সুন্দর সময় ফেরত আনার যারা বিদেশে টাকা নিয়ে গেছেন, হয়ত জেনে বা না জেনেও নিয়ে গেছেন। অর্থনীতির মূলধারায় ওইসব টাকা ফেরত আনার ব্যাপারে কাজ করছি। আমরা বাজেটে বলেছি, প্রশ্ন করা হবে না রেমিট্যান্সের ব্যাপারে। সেটি করা হয়নি। এক্ষেত্রেও কোনো প্রশ্ন করা হবে না। এখন বাঁচার একমাত্র উপায় সরকারের আইন-কানুনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে টাকা ফেরত আনা।

কালোটাকা বিনিয়োগ প্রসঙ্গে : প্রস্তাবিত বাজেটে আইটি ক্ষেত্রে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া কতটা সফল হবে জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কালো নয়, অপ্রদর্শিত টাকা বলা হয়। জমি, ফ্ল্যাট কেনাবেচনায় সঠিক মূল্য দেখানো হয় না। এতে অনেক টাকা অপ্রদর্শিত থেকে যায়। সে টাকাগুলো প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

অর্থনীতির সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এবার বাজেটে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেশের জনগণের নতুন নতুন আশা ও সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। প্রতিটি খাতে আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে প্রান্তিকসহ আপামর দেশের মানুষ উপকৃত হবেন। এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতি আরও শক্তিশীল করা হবে। উন্নয়নমুখী ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। এবার বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, কোভিডের অভিঘাত-পরবর্তী উন্নয়নের ধারাবাহিকতা।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, অনেক সময় বলা হয় সুইচ ব্যাংকে বাংলাদেশের পাচারের টাকা আছে। এর ৯৫ শতাংশ দেখা গেছে বিদেশে বাংলাদেশির ব্যবসা-বাণিজ্যের টাকা অথবা ব্যাংকে যেগুলো সেটেলমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে সুইচ ব্যাংকে আছে এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by DATA Envelope
Top