নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি * খেলাপি ঋণ অন্যতম বড় সমস্যা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
আয় বাড়ানো বড় চ্যালেঞ্জ
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ৩ মে ২০২৪ ০৩:২৮

সরকারের একটি নির্দিষ্ট সময়ের আয়ব্যয়ের খতিয়ান হচ্ছে বাজেট। এটি তৈরি করতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, বহিঃখাত, সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ সবকিছু বিবেচনায় নিতে হয়। বাংলাদেশে বাজেটে অন্যতম সমস্যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আদায় কম।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা। অনেকদিন ধরে প্রবৃদ্ধি ৭/৮ শতাংশে ছিল। বর্তমানে এ হার কিছুটা কমে গেছে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে দিয়েছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বলেছে, প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে থাকবে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। এ কারণে নিু ও মধ্যবিত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি কমছে। কারণ, উন্নত দেশগুলো তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
তৃতীয় বিষয় হলো, আমাদের মুদ্রার বিনিময় হার বেশি। অর্থাৎ ডলারের বিপরীতে ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে টাকা। ডলারের দাম মূল্যস্ফীতি প্রভাবিত করে। কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং কিছু খাদ্যও আমরা আমদানি করে থাকি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত। তবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কাম্য নয়। মূল্যস্ফীতির কারণে নিু-আয়ের মানুষের যাতে ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
অন্যদিকে দেশে বৈষম্য বাড়ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আঞ্চলিক বৈষম্য। যেমন : রংপুর ও বরিশালে ঢাকা ও চট্টগ্রামের চেয়ে দারিদ্র্যের হার বেশি। সেক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেসব বরাদ্দ দেওয়া হয়, এর সুবিধা প্রকৃত লোকজন পায় না। তাই এখানে দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাজেট হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের আয়ব্যয়ের খতিয়ান। কীভাবে অর্থ আয় হবে এবং কীভাবে কোন খাতে কত পরিমাণ ব্যয় করা হবে, এর একটি সম্ভাব্য খতিয়ানই হচ্ছে বাজেট। সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রতিটি দেশই চায় কীভাবে সর্বাধিক জনকল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বাজেট প্রণয়নের সময় বিভিন্ন রকম চাপ থাকে। অনেক সময় সরকার সে চাপের সামনে নতি স্বীকার করে। এতে বাজেট থেকে যেভাবে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়ার কথা, তা অনেক সময়ই পাওয়া যায় না।
এসব কারণে বাজেটে অন্যতম চ্যালেঞ্জ থাকে রাজস্ব আদায়। দেশে জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের যে হার, তা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। পৃথিবীর যেসব দেশের কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর আদায়ের হার বাড়ছে না, বরং আরও কমছে। এটি খুবই উদ্বেগজনক।
রাজস্ব খাতে ব্যর্থতার কারণে বাজেটে যেসব ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন, সেখানে ব্যয় বাড়ানো যাচ্ছে না। দেশে বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু আর্থিক স্বল্পতায় তা বাড়ছে না।রাজস্ব বাড়ানোর জন্য অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এজন্য বর্তমান করদাতাদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে নতুন করদাতা শনাক্ত করা জরুরি। তাদের কর নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে কর ফাঁকি রয়েছে। যেমন : ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক দোকানদার রসিদ দেয় না। তারা টাকা আদায় করলেও সরকারের কোষাগারে জমা দেয় না। আয়করের ক্ষেত্রে টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) যাদের আছে, রিটার্ন জমা দেয় তার অর্ধেক। বাকি অর্ধেককে কেন পাওয়া যাচ্ছে না, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। ফলে আমাদের করদাতা বাড়ানো জরুরি। তবে এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব, না তারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত-সেটি ভেবে দেখা দরকার।বর্তমানে সরকারের রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক না। ফলে চলতি অর্থবছরের যে লক্ষ্যমাত্রা, তা আদায় করা সম্ভব নয়। ফলে খরচের জন্য সরকারকে ধার করতে হয়। এখানেও দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমছে। ফলে বিনিয়োগেও প্রভাব পড়বে। ভর্তুকি কমানোর প্রয়োজন আছে। ভর্তুকি কমানোর আগে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে কৃষিতে ভর্তুকি অবশ্যই থাকতে হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: