দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতিতে রেকর্ড
নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২ আগস্ট ২০২২ ১৫:২৯

করোনা সংক্রমণ কমায় বিশ্বব্যাপী যখন চাহিদা বাড়ছিল, ঠিক সে সময়ে শুরু হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। যে কারণে গত অর্থবছরে আমদানিতে খরচ হয়েছে ৮২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। একই সময়ে যেখানে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৯ বিলিয়ন ডলার। এতে করে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ওপরে উঠেছে। আর দেশের চলতি হিসাবে রেকর্ড প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি হয়েছে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছর যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্নিষ্টরা জানান, বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লেনদেন ঘাটতিতে রেকর্ড হয়েছে। অবশ্য আমদানি ব্যয় কমাতে এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিলাসবহুল পণ্যে শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিনের হার নির্ধারণের পাশাপাশি ঋণ বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া যে কোনো পণ্যে ৩০ লাখ ডলারের বেশি অঙ্কের এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হচ্ছে। ব্যাংকের পাশাপাশি মানিচেঞ্জারে অভিযান চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডিজিটাল হুন্ডি বন্ধেও বিভিন্ন পদক্ষেপ চলমান। এ রকম বিভিন্ন উদ্যোগের প্রভাবে জুলাই মাসে এলসি খোলা কমেছে। জুলাইতে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২১০ কোটি ডলার। এ ধারা বজায় থাকলে বিদেশের সঙ্গে লেনদেনে চাপ কমবে।
লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতির প্রভাব এরই মধ্যে টাকা-ডলার বিনিময় হারের ওপর পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের চলমান সংকট নিরসনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়। গতকাল বিক্রি করা হয়েছে আরও পাঁচ কোটি ডলার। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াল ১১৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এভাবে ডলার বিক্রির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক কমেছে। গতকাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলারে। গত বছরের আগস্টে যেখানে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রির দর এক বছরে ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৯৪ টাকা ৭০ পয়সায় উঠেছে। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স পর্যায়ে দর আরও অনেক বেড়ে ১০০ টাকার ওপরে উঠেছে।
মতামত জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পরিসংখ্যান পুরো অর্থবছরের চিত্র। চলতি হিসাবে এবং বাণিজ্যে ব্যাপক ঘাটতির প্রভাব ইদানীংকালের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের পরিস্থিতিতে প্রতিফলিত। বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। অন্যদিকে সেবা খাতে ঘাটতি বেড়েছে গত ছয় মাসে প্রচুর মানুষ বিদেশে যাওয়ার কারণে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি কত উঁচুতে উঠতে পারে, তা বাংলাদেশ দেখে ফেলেছে। তবে আগামীতে ঘাটতি কমে আসবে। কারণ, আগামীতে রেমিট্যান্স বাড়বে। বৈশ্বিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে আসছে। ফলে আমদানি খরচ কমবে। পাশাপাশি সরকার আমদানি নিরুৎসাহিত করছে। সরকারের নিজস্ব ব্যয়ও কমাচ্ছে। আবার বহুজাতিক সংস্থা থেকে ঋণ পাওয়ার চেষ্টা চলছে। রপ্তানি সামান্য কমলেও লেনদেনে ঘাটতি কমে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরের চেয়ে যা ৩৬ শতাংশ বেশি। এ সময়ে রপ্তানি আয় ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৯২৫ কোটি ডলার। রপ্তানি আয় অনেক বাড়লেও আমদানির সঙ্গে ব্যবধান বেড়েছে। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার। গত অর্থবছর রেমিট্যান্স কমেছে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। রেমিট্যান্স ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারে নেমেছে। আগের অর্থবছর যেখানে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার। এতে করে চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে ১ হাজার ৮৭০ কোটি ডলারে উঠেছে। আগের অর্থবছর যেখানে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল মাত্র ৪৫৮ কোটি ডলার। ঘাটতি বেড়েছে তিন গুণের বেশি।
চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকলেও আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত অনেক বেড়েছে। উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। আর্থিক হিসাবে এই উদ্বৃত্তের বড় কারণ বৈদেশিক ঋণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এ সময়ে নিট বিদেশি ঋণ এসেছে ৮২৮ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে যা ৬০৩ কোটি ডলার ছিল। এর মানে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ২২৫ কোটি ডলার বা ৩৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২১৮ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৬০ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি। আমদানি ব্যয় ব্যাপক বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স কমার কারণে আর্থিক হিসাবের ভালো অবস্থাও লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি কমাতে পারেনি। অবশ্য বিদেশি বিনিয়োগ এবং ঋণ না বাড়লে ঘাটতি আরও অনেক বেড়ে যেত।
কোন পণ্য আমদানিতে কত ব্যয় :কোন পণ্য আমদানিতে কেমন খরচ হয়েছে সে তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছর গম আমদানি ব্যয় ১৭ শতাংশ বেড়ে ২১৪ কোটি ডলার হয়েছে। তবে চালে ৫০ শতাংশ কমে ৪৩ কোটি ডলারে নেমেছে। ভোগ্যপণ্য আমদানিতে সামগ্রিকভাবে ৩৯ শতাংশ বেড়ে ৫৭৮ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে শুধু মসলায় ১০ শতাংশ কমে ৩৬ কোটি ডলারে নেমেছে। এ ছাড়া ভোজ্যতেলে ৫০ শতাংশ বেড়ে ২৮৯ কোটি, ডালে ২২ শতাংশ বেড়ে ৮৩ কোটি, চিনিতে ৬০ শতাংশ বেড়ে ১২৮ কোটি এবং দুধ ও ক্রিমে ২২ শতাংশ বেড়ে ৪২ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় ৪৩ শতাংশ বেড়ে ৫৪৬ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। অন্য মূলধনি পণ্যে ১৯ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৯৭ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে।
পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি বা দেশে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করা হয়। গত অর্থবছর কাঁচামাল আমদানিতে খরচ ৪৪ শতাংশ বেড়ে ৫ হাজার ৫১৯ কোটি ডলারে ঠেকেছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ ৫৮ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ২২৫ কোটি ডলার হয়েছে। অন্য কাঁচামাল আমদানিতে খরচ ৬৪ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৪৯৪ কোটি ডলারে উঠেছে। এর মধ্যে সার আমদানিতে খরচ ২২৩ শতাংশ বেড়ে ৪৩৯ কোটি ডলার হয়েছে। তবে গত অর্থবছর পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে ব্যয় ১১ শতাংশ কমে ৭৯৯ কোটি ডলারে নেমেছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: