ঢাকা | সোমবার, ৭ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১

ঝলসানো শরীরে বেডে কাতরাচ্ছে প্রিয় মানুষ, বাইরে স্বজনদের আহাজারি

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ৭ জুন ২০২২ ১০:২৬

ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে আহত এবং তাদের স্বজন

প্রিয় মানুষটি যখন হাসপাতালের বেডে ঝলসানো শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছেন তখন বাইরে অপেক্ষমাণ স্বজনেরা আহাজারি করছেন। ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে আহত এবং তাদের স্বজনদের এমনটাই দেখা গেল ।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় বিএম কনটেইনার কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে আহত ১৬ জন ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি। এদের মধ্যে চারজন আছেন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ)। এছাড়া একজনকে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়েছে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, মাত্র দেড় বছরের নিশাত তাসনিম সাদাকাও মা মিথিলার গলা জড়িয়ে কান্না করছেন। কারও স্বামী, কারও ভাই আবার কারও নিকট আত্মীয়দের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। ভর্তি রোগীদের অর্ধশতের বেশি স্বজনের নির্ঘুম সময় কাটছে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে।

সোমবার বেলা ১১ টায় বার্ন ইনস্টিটিউটের চতুর্থ তলায় আইসিইউএর সামনে গিয়ে দেখা যায়, দগ্ধ ফায়ার সার্ভিস কর্মী মো. রবিনের স্ত্রী বর্ণা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। বারবার স্বামী রবিনকে দেখার জন্য আইসিইউর সামনে যাচ্ছেন। রবিনের বাবা ষাটোর্ধ্ব হোসেন আলী এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন। আইসিইউএর ১২ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন রবিন। 

রবিনের শাশুড়ি মরজিনা বেগম জানান, তাদের বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার ঘিওর এলাকায়। মাত্র এক বছর হলো মেয়ে বর্ণাকে বিয়ে দিয়েছেন ধামরাইয়ের বাসিন্দা রবিনের সঙ্গে। ঘটনার দিন রাতে আগুন নেভাতে যাওয়ার আগে ফোন করে স্ত্রী ও শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলেন বলে জানান মরজিনা। চিকিৎসকেরা জানান, রবিনের ৬০ ভাগ পুড়ে গেছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।     

আরেক ফায়ার সার্ভিস কর্মী গাউসুল আজম। তিনিও আইসিইউতে ১১ নম্বর বেডে আছেন। বাইরে অপেক্ষায় আছেন দুলাভাই মিজানুর রহমানসহ স্বজনেরা। মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে জানান, তাদের বাড়ি যশোরের মনিরামপুরে। দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন গাউসুল। তার ৫ মাসের একটি ছেলে আছে। স্ত্রী কাকলি আক্তার ছেলে সিয়ামকে নিয়ে বাড়ি থেকে রওনা হয়েছেন বলে তিনি জানান।  

ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, আইসিইউতে থাকা চারজনের অবস্থায় জটিল। তবে এদের মধ্যে রবিন ছাড়া ফায়ার সার্ভিস কর্মী গাওসুল আজমের ৮০ ভাগ, ফরমানুল ইসলামের ৩০ ভাগ ও মাকফারুলের ১২ ভাগ দগ্ধ হয়েছে।  

এছাড়া পোস্ট অপারেটিভে থাকা খালেদুর রহমানের ১২ ভাগ, কামরুল হাসানের ৪ ভাগ, মইনুল হকের ২০ ভাগ, আমিনের ৫ ভাগ, ফারুকের ৫ ভাগ, রুবেলের ১২ ভাগ, মহিবুল্লাহর ১৫ ভাগ, মাসুম মিয়ার ৪ ভাগ, ফারুকের ১২ ভাগ, নজরুলের ২০ ভাগ ও সজীবের ৭ ভাগ দগ্ধ। রাসেল নামের একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে।

বার্ন ইনস্টিটিউটে ঢোকার মুহূর্তেই নিচ তলায় আহত কাভার্ড ভ্যান চালক মো. সজীবের (৩০) স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। পোস্ট অপারেটিভে চিকিৎসাধীন সজীবের স্ত্রী ও মেয়ে এ সময় বিলাপ করছিলেন। 

তারা জানান, আগুন লাগার পর স্ত্রী মিথিলা ও দেড় বছর বয়সের মেয়ে নিশাত তাসনিম সাদাকার সঙ্গে কথা বলেন সজীব। কথা বলা অবস্থায় বিস্ফোরণ ঘটে। এর পর আর স্বামীর খোঁজ পাচ্ছিলেন না মিথিলা।

তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় সজীব। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঢাকার আগারগাঁও তালতলা জনতা হাউজিংয়ে থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলার লাল মোহনের পদ্মা মোনসা গ্রামে তাদের বাড়ি।

ছোট ভাই সবুজ বলেন, ঘটনার পর চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ছিলাম। সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে আসছি। কাভার্ড ভ্যানে মালামাল নিয়ে ওই ডিপোতে যায় সজীব।

আহত সজীবের বরাত দিয়ে সবুজ জানায়, আগুন লাগার পর ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩০০ ফিট দুরে দাঁড়িয়ে ভিডিও কলে স্ত্রী মিথিলার সঙ্গে কথা বলছিলেন সজীব। হঠাৎ বিস্ফোরণ হলে উনি ১০ ফিট মতন পেছনে ছিটকে পরেন। এ সময় আরেক কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার তার বুকের ওপর এসে পড়ে। কেমিক্যালে শরীরের বিভিন্ন স্থান পুরে যায়। সমস্ত আকাশ জুড়ে উল্কা পরছে এমন মনে হচ্ছিল সজীবের। ওই অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে আগুন থেকে দুরে ডিপোর শেষ প্রান্তে গাড়ি রাখে। চোখে কেমিক্যাল পড়ার কারণে চোখ মেলতে পারছিল না সে। ওই অবস্থায় গাড়ি থেকে নেমে সীমানা প্রাচীরের সঙ্গে গায়ে কাপর পেঁচিয়ে শুয়ে ছিলেন সজীব। সেখানেও কেমিক্যাল ছিটে ছিটে গায়ে লাগতে থাকে। এ সময় মারা যাচ্ছে ভেবে কলমাও পড়েছে। পরে অন্য গাড়ির লোক সজীবকে পকেট গেট দিয়ে ডিপো থেকে বের করে।

আইসিইউতে থাকা ফরমানুল ইসলামের বন্ধু বেলাল উদ্দিন জানান, ঘটনার সময় আগুনের ভিডিও করে বেলালকে পাঠায়। এ সময় কয়েকবার কথাও হয়। এর পর কেমিক্যালের আগুনে দগ্ধ হয় সে। আহত অবস্থায় তাকে হেলিকপ্টারে করে আনা হয়েছে। তিনি জানান, ফরমানুল পরিবারের বড় সন্তান। তার ছোট তিন বোন রয়েছে।

ফরমানুলের চাচি ফরিদা ইয়াসমিন জানান, ডিপোতে রিসিভারের কাজ করত সে। বাবা বৃদ্ধ কৃষক। ফরমানুল ছিল পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by DATA Envelope
Top