ঢাকা | বুধবার, ৯ এপ্রিল ২০২৫, ২৬ চৈত্র ১৪৩১
দিতে হচ্ছে না কোন ভর্তুকি

মুনাফার ৪৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংক বাণিজ্য বিপিসির

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ১০ আগস্ট ২০২২ ০০:০০

মুনাফার ৪৮ হাজার কোটি টাকা দিয়ে ব্যাংক বাণিজ্য বিপিসির

গত মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিসিপি) পুঞ্জীভূত মুনাফা হয়েছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক বেশিতে ভোক্তার কাছে জ্বালানি বিক্রি করে এ অর্থ লাভ করে।

আট বছরে সংস্থাটি এ পরিমাণ মুনাফা করে। এ সময়ে তাদের কোনো ভর্তুকি দিতে হয়নি। লাভের টাকা ব্যাংকে এফডিআর হিসাবে আছে। এখান থেকে সুদ বাবদ মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করছে।

বিপিসি একবার তেলের দাম প্রতি লিটারে কমিয়েছে মাত্র ৩ টাকা। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিপিসির বকেয়া ও শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ ৫০৬৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আর শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ টাকা।

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত শুক্রবার বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, বিপিসি গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ছয় মাসে আট হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা যায়, চলতি ২০২২ সালের ২২ মে পর্যন্ত বিপিসি মুনাফা করেছে ১২৬৪ কোটি টাকা। 

জানা যায়, সংস্থাটির মোট লাভ থেকে সরকার নিয়ে গেছে ১২ হাজার কোটি টাকা। আয়কর পরিশোধ হয়েছে ৫৭০ কোটি টাকা। ব্যাংকে আছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা।

এর পরও বিপিসি অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত না নিয়েই জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির পরও বিপিসি তেল বিক্রি করে লাভ করেছে। এখন নতুন দাম নির্ধারণের পর মুনাফা আরও বাড়ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, তাদের মত নিলে দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন হতো না। 

এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিপিসি জনগণের টাকা দিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়েছে। এসব অর্থ ব্যাংকে এফডিআর করে সুদ খাচ্ছে। সেখানে রেকর্ড পরিমাণে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি কোনোভাবেই যৌক্তিক হয়নি। তারা বলেন, বিপিসির কাছে যে অর্থ আছে, তা দিয়ে বর্তমান দরে আগামী ২১ মাসের জ্বালানি তেল আমদানি সম্ভব। 
তাদের মতে, জ্বালানি তেলের নতুন দামের কারণে সব পণ্য ও সেবার মূল্য অসহনীয়ভাবে বেড়ে যাবে। এদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় বাড়ছে না। কর্মসংস্থান হচ্ছে না।

এ অবস্থায় মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়ে যাবে। জনজীবনে দুর্ভোগ আরও বাড়বে। তারা তেলের দাম বাড়ানোর নির্দেশনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। 

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় বিপিসি লোকসান দিচ্ছে। এখন তেলের দাম না বাড়িয়ে কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দাম না বাড়িয়ে যে দামে তেল বিক্রি করছিল তাতেও বিপিসির মুনাফা হচ্ছিল।

সমীক্ষার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) গত অর্থবছরে নিট মুনাফা করেছে ১২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট মুনাফা হয়েছিল সর্বোচ্চ ৯৫৫৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫০৬৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৭৬৮ কোটি ৪২ লাখ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৬৪৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৬৫৩ কোটি ৪০ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯০৪০ কোটি ৭ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪১২৬ কোটি ৮ লাখ টাকা এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নিট লাভের পরিমাণ ছিল ২৩২১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। সূত্র জানায়, মুনাফার এই অর্থ বিপিসি ভালো ব্যাংকে জমা রাখার পাশাপাশি অনেক দুর্বল ব্যাংকেও জমা রেখেছে। ফলে অর্থ আদায় নিয়ে বিপিসিকে মাঝে বেকায়দায়ও পড়তে হয়েছে। 

জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে তেল আমদানির অভিযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে সংস্থাটি টাকা পাচার করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ ধরনের একটি ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়েছে। ওই সময়ে বিপিসি আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে তেল আমদানি করেছে।

পরে ঘটনাটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনায় ধরা পড়ে। বিষয়টি তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে জানানো হয়। তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়েও কম দামে তেল আমদানি করা হয়। ওই ঘটনার পর সংস্থাটি দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়ে কম দামে তেল আমদানি করেছে। তারপর ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বিপিসি আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে তেল আমদানি করেছে। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার যখন তেল আমদানির চুক্তি করে, তখন বাল্ক বা অনেক বেশি পরিমাণে করে। এতে উৎপাদক সরকারকে বাজার দরের চেয়ে কম দামে তেল সরবরাহ করে। বিপিসিতে তদারকি বাড়ালে ঠিকই তারা বাজার দরের চেয়ে কিছুটা কম দামে তেল কিনতে পারে। 

এদিকে জ্বালানি তেল আনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শুল্ক কর ও মূসক ধার্য করায় আমদানি ব্যয়ের চেয়ে আরও বেশি অর্থ জনগণের পকেট নিয়ে যাচ্ছে সরকার। তেল আমদানিতে গড়ে ৩২ শতাংশ শুল্ক ও ভ্যাট রয়েছে।

অর্থাৎ ১০০ টাকার তেল আমদানি করলে সরকার কর বাবদ দিচ্ছে ৩২ টাকা। এর বাইরে বিপিসি যে মুনাফা করছে, তা থেকে সরকার করপোরেট কর আদায় করছে। এভাবে মোট কর বাবদ ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ৫৭০ কোটি টাকা নিয়েছে বিপিসি।

এর মধ্যে করপোরেট কর ১৫০ কোটি টাকা এবং তেল আমদানির বিপরীতে শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ নিয়েছে ৪২০ কোটি টাকা। শুধু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকে গচ্ছিত এফডিআরের বিপরীতে সুদ পেয়েছে ১৬৯ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ব্যয় হচ্ছে ৬২ টাকা। আগের দাম ৮০ টাকা লিটার বিক্রি করলেও বিপিসির মুনাফা ছিল। এখন দাম বাড়িয়ে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা করা হয়েছে।

প্রতি লিটারে মুনাফা হবে ৫২ টাকা। কেরোসিনের আমদানি মূল্য পড়ছে ৬২ টাকা। আগের দামে বিক্রি করলেও বিপিসির মুনাফা হতো। কিন্তু দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ১১৪ টাকা। এতে প্রতি লিটারে মুনাফা হচ্ছে ৫২ টাকা।

পেট্রল আমদানিতে প্রতি লিটারের খরচ পড়ছে ৬৯ টাকা। তা বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা। প্রতি লিটারে মুনাফা হচ্ছে ৬১ টাকা। অকটেনের আমদানিতে প্রতি লিটারে খরচ পড়ছে ৭২ টাকা।

এখন বিক্রি করা হচ্ছে ১৩৫ টাকা। প্রতি লিটারে মুনাফা ৬৩ টাকা। এ ছাড়া পেট্রল ও অকটেনের একটি বড় অংশই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। কর ও বিভিন্ন খাতে কমিশনের কারণে তেলের খরচ বাড়ছে।

ওইসব খাতে কর ও কমিশন কমানো হলে তেলের দাম বরং কমানো যেত। বিপিসি সব ধরনের কর ও কমিশন পরিশোধ করেও মুনাফা করছে। ফলে এবার দাম না বাড়ালেও চলত। এসব অর্থ চলে যাচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলোর পকেটে। বেশির ভাগ অকটেন ও পেট্রল উৎপাদন করে বেসরকারি কোম্পানি। 

তেলের দাম বাড়ানোর কারণ হিসাবে সরকার থেকে বলা হচ্ছে, অব্যাহত লোকসানে বিপিসি প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম। দেশ থেকে তেল ভারতে পাচার হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি নেই। কেননা বিপিসি এখনো লাভে আছে। আগের লাভ থেকে টাকা খরচ করতে পারত। এ ছাড়া ভারতে পাচার নানা কারণেই সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের বৈঠকে দেশ থেকে বিভিন্ন অর্থ ও পণ্য পাচার নিয়ে প্রায়ই কথা হয়। কিন্তু ওই বৈঠকে দেশ থেকে জ্বালানি তেলের পাচারের ব্যাপারে কথা হয় না বললেই চলে। দেশ থেকে তেল পাচার হলে ওই বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা আসত গুরুত্বসহকারে। 

সরকার থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে আবারও কমানো হবে। বাস্তবে বিপিসি একবারই তেলের দাম কমিয়েছে প্রতি লিটারে মাত্র ৩ টাকা। অথচ করোনার সময়ে তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ২০ ডলারে নেমে এসেছিল। সেই সময়ে কমায়নি। অথচ দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়েছে। 

সূত্র জানায়, বিপিসি আট বছর ধরে মুনাফা করে আসছে। ওই সময়ে তাদের কোনো ভর্তুকি দিতে হয়নি। ২০১৩ সালে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেল ৯৪ ডলার থেকে কমে ২০১৬ সালে ৪০ ডলারের নিচে নেমে আসে।

২০২০ সালে তা সর্বনিম্ন ২০ ডলারে নেমে আসে। ওই সময়ে দীর্ঘদিন প্রতি ব্যারেল ৩০ থেকে ৫০ ডলারের মধ্যে ছিল। ওই সময়ে দাম কমানো হয়নি। শুধু ২০১৬ সালে এপ্রিলে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি মাত্র ৩ টাকা কমানো হয়েছিল। ওই সময়ে বিপিসি কম দামে তেল কিনে তা ভোক্তার কাছে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে বিক্রি করে মুনাফা করেছে। 

গত ৮ বছরে বিপিসি ৪৮ হাজার কোটি মুনাফা করেছে। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা সরকার নিয়ে গেছে। বাকি অর্থের মধ্যে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা আছে বিভিন্ন ব্যাংকে।

এর মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি এফডিআর হিসাবে বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা আছে। দীর্ঘমেয়াদি আমানত কেবল সচ্ছল প্রতিষ্ঠানগুলোই করে। কোনো দুর্বল বা লোকসানি প্রতিষ্ঠান এফডিআর করতে পারে না। আর স্বল্পমেয়াদি এফডিআর হিসাবে আছে ৩ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা তেল বিক্রি বাবদ বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম  বলেন, বিপিসি দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান সবই মিথ্যা তথ্য। তাছাড়া বিপিসি’র দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কারণ এই সংস্থার কাছে এখনো অনেক টাকা গচ্ছিত রয়েছে। এই টাকা তারা ব্যাংকে ডিপোজিট করেছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। তিনি বলেন, হঠাৎ করে এত বেশি তেলের দাম বাড়ানো হবে সে বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। মতামত নেওয়া হলে অবশ্যই এত বেশি দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ত না। এই দাম ধাপে ধাপেও বাড়ানো যেত।

সরকারি কোষাগারে বিপিসির জমা দেওয়া লভ্যাংশের পরিমাণ : সরকারি কোষাগারে বিপিসি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা লভ্যাংশ জমা দিয়েছে।

এর আগে বিপিসি কোনো অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিপিসির বকেয়া ও শ্রেণি বিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ ৫০৬৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা আর শ্রেণি বিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ ১৪ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, বিপিসি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামো নির্মাণ করতে অনেক অর্থ খরচ করছে। এগুলো সবই বিলাসী প্রকল্প। জনগণের টাকায় মুনাফা করে বিলাসী প্রকল্প নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বৈদেশিক ঋণের টাকায়। এর মধ্যে পদ্মা অয়েলের নামে ঢাকার শাহবাগে ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ১২ তলা ভবন নির্মাণ। এটি একটি আবাসিক ভবন হবে। একই সঙ্গে চট্টগ্রামেও এ ধরনের বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
 




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by DATA Envelope
Top