ঢাকা | বুধবার, ৯ এপ্রিল ২০২৫, ২৬ চৈত্র ১৪৩১
কার্যকর উদ্যোগের অভাব

পাচারের অর্থ ফেরানোর কাজে নেই সমন্বয়

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০০:১৭

পাচারের অর্থ ফেরানোর কাজে নেই সমন্বয়

বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরানোর ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগের অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনানুযায়ী পাচার করা সম্পদের সুনির্দিষ্ট তথ্য চাইতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে অনেক দেশ তথ্য দিচ্ছে না। এ ধরনের তথ্য চাওয়ার মতো একক কোনো সংস্থা দেশে এখনো গড়ে উঠেনি। যারা কাজ করছে তাদের মধ্যে সে অর্থে সমন্বয় নেই।

বর্তমানে দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) এ ব্যাপারে কিছু কাজ করছে। কিন্তু পাচার করা সম্পদ ফেরানোর ক্ষেত্রে সব সংস্থার কার্যক্রম তদারকির বিষয়ে তাদের আইনি ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বেশ কয়েকটি সংস্থা। ফলে তদারকির বিষয়টিও খুব বেশি এগোচ্ছে না।

সূত্র জানায়, সংস্থাগুলো যদি সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে তবে পাচার করা সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। ২০০৭-০৮ সালে তাৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য চেয়ে অনেক দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকেও সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য চেয়ে অনেক দেশ থেকে সংগ্রহ করার নজির রয়েছে। কিন্তু বড় বড় পাচারকারীদের ব্যাপারে কোনো তরফ থেকেই তথ্য চাওয়া হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পাচার করা টাকা ফেরানোর বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত হলে অনেকে ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য চাওয়া সম্ভব। সে সক্ষমতা দেশি সংস্থাগুলোর অনেকেরই রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে পাচার করা সম্পদ ফেরানোর বিষয়টি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় দরকার। যা এখন নেই। অনেক দেশে এ ধরনের আলাদা সংস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। আন্তঃসংস্থা যে টাস্কফোর্স আছে সেটিও সমন্বয় করতে পারছে না। কেননা এখানে একক কোনো নির্দেশ কার্যকর নেই।

সূত্র জানায়, পাচার সম্পদ ফেরাতে সরকারিভাবে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের বাজেটে পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনলে কর মওকুফ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স নতুন করে পুনর্গঠন করা হয়েছে। সুইস ব্যাংক থেকে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে বিএফআইউর প্রধানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

টাকা পাচার বন্ধ ও পাচারের ঘটনা শনাক্ত করতে মানি লন্ডারিং বিষয়ক প্রতিটি রিপোটিং প্রতিষ্ঠানে আলাদা তদন্ত ইউনিট গঠনের গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর আলোকে কয়েকটি সংস্থায় এ ইউনিট গঠন করা হয়েছে। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) কোম্পানি আইন সংশোধন করে মানি লন্ডারিং বিষয়ক তথ্য আদান-প্রদানে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোকে বাধ্যা করা হচ্ছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে মানি লন্ডারিং বিষয়ক মামলা করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে মামলার গুণগত মান ও ফলাফলের দিকে নজর দিতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনতে যে কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে তার সুফল এখন পর্যন্ত মেলেনি। তবে অর্থবছর শেষে আয়কর রিটার্ন দেওয়ার সময় তাতে উল্লেখ করতে হবে বিদেশে থাকা কোনো সম্পদ তিনি দেশে এনেছেন কিনা। বা বিদেশে সম্পদের ঘোষণা দিয়েছেন কিনা। এর আগে বিষয়টি স্পষ্ট হবে না। তবে এতে সাড়া না পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিষয়টি দেশে-বিদেশে প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা পাচার সম্পদ ব্যাংকের মাধ্যমে আনতে হবে।

আন্তঃসংস্থার কাজের সমন্বয়ের জন্য ইতোমধ্যে টাস্কফোর্স নতুন করে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর একটি বৈঠকও হয়েছে। ওই বৈঠকে পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বিএফআইইউ ইতোমধ্যে একটি প্রতিবেদন টাস্কফোর্সের বৈঠকে উপস্থাপন করেছে। এখন সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।

সুইস ব্যাংক থেকে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে বিএফআইউর প্রধানের নেতৃত্বে যে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে তারা একাধিকবার বৈঠকে বসে কিছু কর্মপন্থা ঠিক করেছে। এর মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যেসব দেশ সুইস ব্যাংক থেকে তথ্য পেয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। কিন্তু এ যোগাযোগটি এখনও কার্যকর হয়ে উঠেনি।

টাকা পাচার বন্ধ ও টাকা পাচারের ঘটনা শনাক্ত করতে মানি লন্ডারিং বিষয়ক প্রতিটি রিপোর্টিং প্রতিষ্ঠানে আলাদা তদন্ত ইউনিট গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ১৭টি খাত রয়েছে। এর আলোকে কয়েকটি সংস্থায় এ ইউনিট গঠন করেছে। এখন এ ইউনিটগুলোর কার্যক্রম সমন্বয় করার জন্য বিএফআইইউ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সিআইডি। তারা এ বিষয়ে বিএফআইইউর আইনি ক্ষমতা আছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার কথা বলেছে। ফলে তদারকির জন্য কোনো কার্যক্রম হাতে নেওয়া যাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে বিএফআইইউর এক কর্মকর্তা বলেন, এগমন্ট গ্রুপের মাধ্যমে এবং যেসব দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক আছে ওই দেশ থেকে দ্বিপক্ষীয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সংগৃহীত তথ্য সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে দেওয়া হচ্ছে। এসব তথ্যের বেশিরভাগই সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার বিষয়ক।

সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরাতে হলে একেক দেশের আইন একেক রকম। ওইসব আইনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার দেশে যেমন একক কোনো সংস্থা নেই। তেমনি যোগাযোগের কাঠামোও নেই। আন্তঃসংস্থা সমন্বয় টাস্কফোর্স থেকেও এ ব্যাপারে জোরালো উদ্যোগ নেই।

সুইজারল্যান্ডের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট থেকে তথ্য পেতে হলে ব্যক্তির নাম, পাসপোর্ট নাম্বার, কোন ব্যাংকে, অ্যাকাউন্ট নাম্বারসহ দিতে হবে। কিন্তু বিএফআইইউ’র কাছে এ বিষয়ে সব তথ্য নেই। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এসব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সমন্বয়ের অভাবে সেটিও হচ্ছে না। আর সুইজারল্যান্ড সব ব্যাংক গণহার কোন ব্যক্তির তথ্য অনুসন্ধান করে না।

সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক দেশ থেকে তথ্য আনতে হলে পাচারকারীর কর ফাঁকির অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। এ ধরনের কোনো মামলার রায়ের ভিত্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ওই দেশের আয়কর কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চাইতে হবে। এভাবে তথ্য পাওয়া সহজ। ভারত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এই প্রক্রিয়ায় সুইজারল্যান্ড থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। সে কাঠামো এখনও হয়নি।

গত মে মাসে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করার পর সেখান থেকে এনবিআরের চেয়ারম্যানকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আগে তিনি ছিলেন। এর পরিবর্তে এনবিআরের দুজন প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। কিন্তু সংস্থায় এনবিআরের চেয়ারম্যান যেভাবে তৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন সেটি ওই দুই প্রতিনিধির পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে না। এতে মূল কাজ বাধাগ্রস্ত হবে।

যুক্তরাজ্য থেকে তথ্য আনতে হলে বড় ভূমিকা রাখে সে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই অফিসের সঙ্গেই যোগাযোগ করে অনেক নামি-দামি রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে টাকা পাচারের তথ্য সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে ওই অফিসের সঙ্গে যোগাযোগের কাঠামো নেই। তবে বিএফআইইউ থেকে সব দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। ওইখানে শর্ত থাকছে ওইসব তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। আদালতে সাক্ষী হিসাবে উপস্থাপন করা যাবে না। শুধু তদন্তের কাজে ব্যবহার করা যাবে।

আমদানি-রপ্তানির আড়ালে যেসব অর্থ পাচার হয় সেগুলো ব্যাংক, কাস্টমস ও বন্দরে নিবিড়ভাবে তদন্ত করে বের করা সম্ভব। কিন্তু এমন যৌথ তদন্ত হচ্ছে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও কাস্টমস বিচ্ছিন্ন কিছু তদন্তের মাধ্যমে কিছু ঘটনা শনাক্ত করেছে। ওইগুলো নিয়ে মামলা পর্যন্তই শেষ। আর কোনো অগ্রগতি নেই।

এখন পর্যন্ত গত ৮ বছরে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট ৭৯টি দেশের সঙ্গে অর্থ পাচার, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বিষয়ক তথ্য আদান-প্রদান করার জন্য দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এর আওতায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করছে।

 




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by DATA Envelope
Top