শিনজো আবে হত্যা: বাংলাদেশে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক
নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ৯ জুলাই ২০২২ ১১:৫৫

হত্যাকারী জানিয়েছে, অ্যাবের ওপর সে অসন্তুষ্ট ছিল। তার ডাবলড-ব্যারেলের বন্দুকটি ছিল হাতে বানানো। শুক্রবার (৮ জুলাই) দক্ষিণাঞ্চলীয় নারা শহরের বাইরে একটি ট্রেন স্টেশন সংলগ্ন সড়কে নির্বাচনী প্রচারের সময় তাকে গুলি করা হয়েছে।
জাপানি সংবাদমাধ্যম এনএইচকে জানিয়েছে, বেলা সাড়ে ১১টায় বক্তব্য দেওয়ার সময় হঠাৎ করে তাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখা যায়। তার শরীর থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছিল। লাল রক্তে ভিজে যায় তার সাদা জামা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত এনএইচকের সাংবাদিক দুটির গুলির শব্দ শুনতে পান।-খবর বিবিসি ও রয়টার্সের
জাপানের দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৬৭ বছর বয়সী আবে। ২০০৬ থেকে ২০০৭ সাল ও ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিনি জাপান শাসন করেন।
১৯৩৬ সালের যুদ্ধপূর্ব সমরবাদের পর জাপানের সাবেক কিংবা বর্তমান কোনো প্রধানমন্ত্রী হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি। যদিও ২০০৭ সালে নাগাসাকির মেয়রকে গুলি করে হত্যা করে এক ইয়াকুজা গ্যাংস্টার। আর ১৯৬০ সালে বক্তৃতা দেওয়ার সময় সামুরাই ছোট তরবারি দিয়ে জাপানি সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রধানকে হত্যা করা হয়।
এছাড়াও যুদ্ধপরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিবিদরা হামলার শিকার হলেও গুরুতর আহত হননি। এ হামলাকে বর্বরতা আখ্যা দিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিসিদা বলেন, নির্বাচনের সময় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আর নির্বাচন হচ্ছে আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তি। কাজেই এ হামলা ক্ষমার অযোগ্য। হামলাকারীকে ক্ষমা করা যায় না।
পুলিশ বলছে, হামলাকারী নারা অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা। ২০০৫ সাল পর্যন্ত জাপানি সামরিক বাহিনীতে তিন বছর কাজ করেছে সে। তবে এ নিয়ে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিসির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
২০২০ সালে স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়লেও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে (এলডিপি) তার প্রভাবশালী উপস্থিতি ছিল। দলটির একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ করতেন আবে।
ক্রমাগত ও দীর্ঘস্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি থেকে দেশের অর্থনীতিকে বের করে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। যে কারণে অনেকটা সাহসের সঙ্গে ‘আবেনোমিকস’ নীতি গ্রহণ করেন। সামরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি চীনের মোকাবিলায়ও চেষ্টা ছিল তার।
২০০৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন আবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এক বছরের বেশি তার সেই মেয়াদ স্থায়ী হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, পেনশন রেকর্ড নিয়ে ভোটারদের ক্ষোভ, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয়ের প্রেক্ষাপটে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে তিনি ক্ষমতা ছাড়েন।
পরে বুঙ্গেই শুনজু সাময়িকীতে তিনি লেখেন, ওই পদত্যাগের কারণ আমাকে বেশি হতাশ করেছে। আবে প্রশাসন যে রক্ষণশীল চিন্তাধারার প্রচার করেছিল, তা আস্তে আস্তে মিইয়ে যাচ্ছে। জাপানে যাতে সত্যিকার রক্ষণশীলবাদের শিকড় গেঁথে যায়, তা নিশ্চিত করতে একজন আইনপ্রণেতা হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই।
তার পদত্যাগের পর এরইমধ্যে পাঁচ বছর চলে যায়। আবে তার রক্ষণশীল দলকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। অস্থিতিশীলতা দূর করে অর্থনীতিকে জাগিয়ে তোলার অঙ্গীকার করে ২০১২ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।
মুদ্রাস্ফীতির রোগ সারাতে তিনি ত্রিমুখী ‘আবেনোমিকস’ নীতি প্রণয়ন করেন। অতিসহজ মুদ্রানীতি ও রাজস্ব ব্যয়ের মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ফিরিয়ে আনেন। দ্রুত-বার্ধক্য ও সংকুচিত জনসংখ্যার লাগাম ধরতে কাঠামোগত সংস্কারে হাত দেন আবে।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর শান্তিবাদী নীতি থেকে জাপানকে বের করে আনার চেষ্টা করেন। জাতীয় মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতিও ছিল তার।
টোকিওতে ২০২০ সালের অলিম্পিক আয়োজনের মূল ভূমিকা ছিল তার। এমনকি ২০১৬ সালের রিও ডি জেনেরিওতে যখন অলিম্পিক হস্তান্তর করা হয়, তখন নিনটেন্দো কোম্পানির ভিডিও গেম চরিত্রেও দেখা গেছে তাকে।
২০২০ সালের গ্রীষ্মে করোনা মোকাবিলায় পদক্ষেপের কারণে তার জনপ্রিয়তা কমে যায়। এছাড়া সাবেক বিচারমন্ত্রীকে গ্রেফতারসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির খবর আসে তখন। অলিম্পিকে সভাপতিত্ব কিংবা সংবিধান সংশোধনের দীর্ঘ ইচ্ছা পূরণ ছাড়াই তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল দুঃসাধ্য। বিক্রয় কর বৃদ্ধি ও চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ২০১৯ সালে তার প্রবৃদ্ধি কৌশল অসফল থেকে যায়। এরপর করোনা মহামারি জাপানের অর্থনৈতিক ধস ভয়াবহ তলানিতে নিয়ে যায়।
করোনা মহামারি শুরু হলে দেশের সীমান্ত বন্ধ ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে লোকজনকে ঘরে থাকতে আহ্বান জানাতে তিনি সময় নেন। এমনকি এ সময়ে দোকানপাট বন্ধ রাখতেও ব্যর্থতা ছিল আবে প্রশাসনের। তার নেওয়া পদক্ষেপকে আনাড়ি তকমা দিয়ে নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সমালোচকেরা।
এরপর আবার অসুস্থতার দোহাই দিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি। যদিও জাপানের করোনায় মৃত্যুহার অন্য উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম ছিল।
এক ধনাঢ্য রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম আবের। তারা বাবা শিয়ান্তারো আবে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আর চাচাত-দাদা নোবোসুকি কিসি প্রধানমন্ত্রী। জাপানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নোবোসুকি কিসির অনেক গুরুত্ব ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি।
পরে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু জাপান-মার্কিন পুনরালোচিত নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে মানুষের ক্ষোভের মুখে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তখন আবের বয়স ছিল পাঁচ বছর। দাদার কোলে বসে খেলতে খেলতে পুলিশের সঙ্গে বামপন্থীদের সংঘর্ষের আওয়াজ শুনতে পেতেন তিনি।
১৯৪৭ সালের মার্কিন-খসড়ার সংবিধান সংশোধনে ব্যর্থ চেষ্টা করেন কিসি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমান-মর্যাদার নিরাপত্তা অংশীদার হতে চেয়েছিলেন তিনি। অত্যন্ত শক্তিশালী কূটনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চান এই রাজনীতিবিদ। এসব নীতি বাস্তবায়নে নোবোসুকি কিসি ব্যর্থ হলেও তা নাতি শিনজো আবের রাজনৈতিক ইশতিহারের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রতিরক্ষা খরচ বাড়িয়েছেন আবে। ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব মোকাবিলায় অন্য এশীয় দেশগুলোকে ছাড়িয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় তাকে। সম্মিলিত আত্মরক্ষা কিংবা হামলার শিকার মিত্র দেশকে সামরিক সহায়তার নীতি গ্রহণ করেন তিনি। বিরোধিতা সত্ত্বেও সেই আইন জাপানের পার্লামেন্টে পাস হয়।
শান্তিবাদী সংবিধানের সংশোধনে তিনি অগ্রাধিকার দিয়ে আসছিলেন। যদিও এ নিয়ে জাপানে বিতর্ক আছে। কারণ দেশটির নাগরিকরা মনে করেন, শান্তিবাদী নীতির কারণে যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানে স্থিতিশীলতা এসেছে। কিন্তু রক্ষণশীলরা মনে করেন, এতে জাতীয় গৌরব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জাপান।
যুদ্ধপরবর্তী মার্কিন দখলদারিত্বের উত্তরাধিকার থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলেন শিনজো আবে। সামাজিক রীতিনীতিতে জাতীয় ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার করতে চেয়েছিলেন তিনি।
বাবার মৃত্যুর পর ১৯৯৩ সালে প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন আবে। অনিশ্চিত প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে তিনি দেশজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কয়েক দশক আগে জাপানি নাগরিকদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল পিয়ংইয়ং।
পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কন্নয়নের চেষ্টা করেন আবে। যদিও যুদ্ধের সময় প্রতিবেশী দুই দেশের সঙ্গে জাপানের তিক্তস্মৃতি রয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালে টোকিওর ইয়াসুকুনি সমাধি পরিদর্শন করে দুই দেশকেই রাগিয়ে তোলেন তিনি। জাপানের অতীত সমরবাদের প্রতীক বিবেচনা করা হয় ওই সমাধিকে।
এরপরে তাকে আর ইয়াসুকুনি সমাধিতে দেখা যায়নি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সেখানে শ্রদ্ধা পাঠাতেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন আবে। তার সঙ্গে গলফ খেলার পাশাপাশি প্রায়ই ফোনালাপ ও বৈঠকে অংশ নিতেন। ২০১৮ সালে পর পর তিনবার এলডিপি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাকে চতুর্থবার দলীয় প্রধান করতে এলপির নেতারা নীতিতে পরিবর্তন আনতেও চেয়েছিলেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: