দরিদ্র নারী-শিশুদের বিচারপ্রাপ্তি সহজ হচ্ছে
সিটি পোষ্ট | প্রকাশিত: ৩ অক্টোবর ২০২১ ১৬:৫৪

বিচারের প্রতি আস্থা রাখলেও দীর্ঘসূত্রতার কারণে বেশিরভাগ মানুষই আইনি প্রতিকারের পথে হাঁটেন না। সরকারি এক প্রতিবেদন বলছে, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখে ৬৮ শতাংশ মানুষ। কিন্তু আইনগত প্রতিকার পেতে আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার দ্বারস্থ হন মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ। প্রতিবেদনটি বলছে, আইনের জটলায় দরিদ্র, অসহায় নারী এবং শিশুদের বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভোগান্তি বেশি হচ্ছে। এই অবস্থায় দক্ষ ও কার্যকর বিচারিক পরিষেবা দেওয়ার জন্য নতুন সংস্কার পদ্ধতি নেওয়া হচ্ছে। এই আইনি সংস্কার আনতে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় আইনজ্ঞকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প সম্পন্ন করা হবে। এর ফলে দরিদ্র, অসহায় নারী এবং শিশুদের বিচারপ্রাপ্তির পথ সুগম হবে বলে আশা করছে সরকারের আইন ও বিচার বিভাগ।
সম্প্রতি এ সংক্রান্ত ‘স্ট্রেনদেনিং অ্যাকসেস টু জাস্টিস অ্যান্ড লিগ্যাল রিফর্ম’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
আইন ও বিচার বিভাগের এই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, একটি তথ্য অনুসারে, ১৩ শতাংশ জনগণ আইনগত প্রতিকার পেতে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাসংশ্লিষ্ট সংস্থার দ্বারস্থ হয়। কিন্তু ৬৮ শতাংশ জনগণ আনুষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখে। সেক্ষেত্রে মূলত তাদের প্রয়োজন দক্ষ ও বিচারবান্ধব একটি আইনের পথ, যা তাদের প্রত্যাশিত ফল পেতে সহায়ক হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করতে বিশেষ করে কারাবন্দিদের আইনগত সহায়তা প্রদানের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মামলাজট নিরসনে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির প্রতিও গুরুত্বারোপ করেছেন। দেশের সংবিধানে নাগরিকদের আইনের দৃষ্টিতে সমতা, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার এবং দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, গত চার বছরের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশের পাঁচজন ব্যক্তির মধ্যে চারজনই এক বা একাধিক বিরোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। বিরোধগুলোর মধ্যে ভূমিসংক্রান্ত, প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিবাদ ও অন্যান্য ক্ষুদ্র বিরোধ উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশ ফৌজদারি বিরোধ ভূমিসংক্রান্ত এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিবাদ থেকে সৃষ্ট। এই অবস্থায় দরিদ্র, অসহায় নারী এবং শিশুদের বিচারপ্রাপ্তি দ্রুত সম্পন্ন করে সুশাসন বৃদ্ধি করা এবং বিচারব্যবস্থার জন্য জবাবদিহিতামূলক দক্ষ ও কার্যকর বিচারিক পরিষেবা দেওয়ার জন্য নতুন সংস্কার পদ্ধতি নেওয়া হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৯২ কোটি ১১ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১২ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জিআইজেড থেকে প্রকল্প ঋণ হিসেবে ৮০ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য রয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় তথ্য-উপাত্তভিত্তিক আইন সংস্কার, ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের মাধ্যমে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় বৃদ্ধি, মামলা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োগ শক্তিশালীকরণ, নতুন কারা আইনের খসড়া প্রণয়নে কারিগরি সহায়তা, নীতি ও পদ্ধতিগত সংস্কারের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সংলাপ করা হবে। এছাড়া স্টেকহোল্ডারদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রচার প্রকাশনাসংক্রান্ত কৌশল প্রণয়ন, কিশোর ও অন্যান্য অসহায় বিচারপ্রার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্যারালিগ্যাল (আইনি সেবাদানকারী) কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হবে।
এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দীর্ঘ মেয়াদে ২৫২ জনমাস (একজন ব্যক্তি যত মাস কাজ করবে) আন্তর্জাতিক ও ২১৬ জনমাস স্থানীয় বিশেষজ্ঞ বা আইনজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হবে। এদের পেছনে ব্যয় হবে ১৯ কোটি টাকা। এছাড়া স্বল্প মেয়াদে ৮৪ জনমাস আন্তর্জাতিক ও ৩৬ জনমাস বিশেষজ্ঞ বা আইনজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হবে। এতে ব্যয় হবে ২০ কোটি টাকা। এছাড়া প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা বাবদ প্রায় ২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মামুন-আল-রশীদ বলেন, ‘জাস্টিস রিফর্ম অ্যান্ড করাপশন প্রিভেনশন’ প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষ ও কার্যকর বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি দেশের জনগণের জন্য নতুন সংস্কার পদ্ধতি নেওয়া এবং সংবিধানের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে নাগরিকদের জন্য আধুনিক, যুগোপযোগী ও কল্যাণমূলক আইনি পরিষেবা বাড়ানো হবে। এতে নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার তথা আইনগত সহায়তা নিশ্চিতে সহায়তা করবে। বিশেষ করে দরিদ্র, অসহায়, নারী এবং শিশুদের বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি এবং বিচারব্যবস্থার জন্য বিচারকি পরিষেবা বাড়বে। তিনি বলেন, সম্প্রতি প্রকল্পটির ওপর বিশেষ মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বেশকিছু বিষয়ে সংশোধনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান দেবোত্তম স্যানাল জানান, বৈদেশিক ভ্রমণ ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে প্যাকেজসমূহ ডিপিপিতে উল্লেখসহ বিস্তারিত বিবরণ ও ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি সংযুক্ত করতে হবে। প্রশিক্ষণ কর্মশালা, সেমিনার এর ব্যয় বিভাজন প্রস্তাবনায় সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া প্রকল্পের অফিস পরিচালনা ব্যয় বাবদ ৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা, অফিস রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ ২ কোটি ৫ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এ অর্থ ব্যয়ে কোন কোন অফিস পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে তার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের জিওবি খাতে পরামর্শক এবং বৈদেশিক খাতে পরামর্শকের বিবরণ পৃথক হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পরামর্শকের যোগ্যতা ও ব্যয় আলাদা আলাদা করে উল্লেখ করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সভার সম্মানী বাবদ জিওবি হতে ৫০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। কোন কোন সভার জন্য এ অর্থ ব্যয় করা হবে তা উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। প্রস্তাবনায় সিটিভ্যাট খাতে আলাদা করে বরাদ্দ রাখার সুযোগ নেই। সিটিভ্যাট সংশ্লিষ্ট মালামালের দামের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করে দেখাতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারিক ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে পারলে মামলার জট দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে একাধিক মামলা ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিবর্তে একটি একক মামলা ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হবে। যার উদ্দেশ্য হবে মামলার বাছাইয়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষমাণ মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করা।
এছাড়া জাস্টিস অডিট এবং অন্যান্য তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির মাধ্যমে আইন সংস্কারের নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশন যুক্ত করে বিচারব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত হবে। জেরার সংবেদনশীল নীতিমালা প্রস্তুত করাসহ মামলার সংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে দরিদ্র ও অসহায় জনগোষ্ঠীর জন্য কমিউনিটি লিগ্যাল সার্ভিস নিশ্চিত করা যাবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: