ঢাকা | সোমবার, ৭ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১

মাধ্যমিকে ঘুষ বাণিজ্য: প্রধান শিক্ষক নিয়োগে ১৫ লাখ টাকা

সিটি পোষ্ট | প্রকাশিত: ১ অক্টোবর ২০২১ ০৫:২৭

প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে সাড়ে ৩ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর গবেষণা চালিয়ে বড় দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি বলছে শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, এমপিওভুক্তি থেকে শুরু করে শিক্ষার এই স্তরের বিভিন্ন কাজে পদে পদে ঘুষ লেনদেন হচ্ছে। অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে সাড়ে ৩ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। এমনকি এনটিআরসিএ কর্র্তৃক সুপারিশ পাওয়া সহকারী শিক্ষকদেরও ঘুষ দিয়ে যোগ দিতে হয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে এ টাকা দিতে হয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবস্থাপনা কমিটিকে। আর বদলি ও এমপিও সুবিধা পেতে টাকা দিতে হয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

গতকাল বুধবার প্রকাশিত ‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে টিআইবি। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন কর্র্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সুপারিশ করা সহকারী শিক্ষকদেরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানের জন্য ২ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এ টাকা দিতে হয় প্রধান শিক্ষক বা পরিচালনা কমিটিকে। শিক্ষক এমপিওভুক্তিতে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ পর্যন্ত টাকা দিতে হয়। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষার কাজে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকের এক মাসের এমপিওর টাকা দিতে হয়। এ টাকা দিতে হয় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। আর শিক্ষক বদলিতে ১ থেকে ২ লাখ টাকা দিতে হয়। এ টাকা দিতে হয় মধ্যস্বত্বভোগী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের অনুমতির জন্যও ১ লাখ থেকে শুরু করে ৫ লাখ এবং স্বীকৃতি প্রদানে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে হয় নিয়মের বাইরে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে মাধ্যমিক শিক্ষায় নানা ধরনের অনিয়ম, সীমাবদ্ধতা ও ভালো-মন্দের চিত্র তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে করণীয় নির্ধারণে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

টিআইবি বলছে, এসব অনিয়মে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সদস্য, প্রধান শিক্ষক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্র্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি।

 

গবেষণা প্রতিবেদনটির জন্য টিআইবি মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করে ২০১৯ সালের মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। সর্বশেষ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরোক্ষ উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। টিআইবি বলছে, গবেষণার জন্য দেশের ১৮টি উপজেলার ৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের নানা পর্যায়ে ৩২৫ জন ব্যক্তি টিআইবিকে তথ্য দিয়েছেন।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি গুণগত গবেষণা। বেশিরভাগ তথ্যদাতা এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। তারা আশা করছেন, সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ এ গবেষণার সুপারিশগুলোর বিষয়ে গুরুত্ব দেবে।

মাধ্যমিক শিক্ষায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি : মাধ্যমিক শিক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নীতিমালা লঙ্ঘন করে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে এমপিওভুক্তির তালিকায় যুক্ত করা হয়। এমপিও সুবিধার প্রক্রিয়া বিকেন্দ্রীকরণ ও অনলাইনে হলেও চারটি স্থানে হাদিয়া বা সম্মানী দিতে হয়। এই চার ধাপ হলো প্রতিষ্ঠান প্রধান, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, জেলা শিক্ষা অফিস ও আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের কার্যালয়। প্রতিটি ধাপে আবেদনের অগ্রগতির জন্য টাকা দিতে হয়। না হলে আবেদনে ত্রুটি, আবেদন অগ্রায়ন না করা এবং অহেতুক সময় ক্ষেপণ করা হয়। এ ছাড়া টাকার বিনিময়ে প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করা হয়।

প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ লেনদেনের ঘটনা ঘটে। এনটিআরসিএ কর্র্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পরও স্কুল-কলেজের তহবিল, উন্নয়ন কাজ, পূর্বে গভর্নিং বডি দ্বারা নিয়োগে অনেক টাকা দিতে হতো ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে টাকা আদায় করা হয়। তিন বছর পরপর বদলির বিধান থাকলেও এটি একেবারেই হয় না। সরকারি হাইস্কুল এবং কলেজের একজন শিক্ষক ১০ বছরের বেশি একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকেন। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা ১০-১২ বছর পর্যন্ত বদলি হন না। সাধারণত তদবির ও নিয়মবহির্ভূত অর্থের মাধ্যমে বদলি বা পছন্দনীয় স্থানে থেকে যান শিক্ষক-কর্মকর্তারা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আইসিটি প্রকল্প ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুমের যন্ত্রপাতি কেনাকাটা নিয়েও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে টিআইবি। দেখা গেছে, আইসিটি প্রকল্প-২-তে প্রশিক্ষণের নামে দরপত্র ছাড়াই ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালকের বছরে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করার ক্ষমতা থাকলেও তিনি ৯৬ লাখ টাকা তুলেছেন। এক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। প্রশিক্ষণে উপস্থিত না থেকেও প্রকল্প পরিচালক সম্মানী নেন প্রায় ১৭ লাখ টাকা। বেসিক টিচার ও প্রতিষ্ঠান প্রধান প্রশিক্ষণের ১ হাজার ১২১টি ব্যাচের ভেন্যু বাবদ প্রায় ২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যা সরকারি অর্থের অপচয়।

জবাবদিহি, সুশাসন ও প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব : গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে টিআইবি বলছে, মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার বা মানোন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ রয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ এই খাতের প্রত্যাশিত উৎকর্ষ অর্জনে এখনো ঘাটতি আছে। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হলেও এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষা খাত উন্নতি না হওয়ার পেছনে শক্তিশালী শিক্ষানীতি না থাকাকে দায়ী করেছে টিআইবির গবেষণা। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নয় এবং জাতীয় বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় বরাদ্দ টাকার অঙ্কে ক্রমান্বয়ে বাড়লেও শতাংশের ক্ষেত্রে এটি গড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। শিক্ষক ও কর্মচারীর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি রয়েছে।

প্রতিবেদন বলছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার মাঠপর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বিত জনবল কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং জনবল সক্ষমতার ঘাটতিতে সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপের ঘাটতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তার হচ্ছে; এবং শিক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে; অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। সার্বিকভাবে মাধ্যমিক শিক্ষার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আইনের ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অতি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, মাঠপর্যায়ে সরাসরি রাজস্ব খাতের আওতাভুক্ত সমন্বিত জনবল কাঠামো তৈরির সুপারিশ করেছে টিআইবি।




আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by DATA Envelope
Top