আগে গেছে ধান, এবার ভিটা
নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২২ জুন ২০২২ ১৩:২৫

সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের দু'পাশেই এখন বানের টেউ। শুধু বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিচঢালা সড়কটি। সামনে এগোলেই জৈন্তাপুরের ফতেপুর। গ্রামের বাঁকে বাঁকে এখনও জলের চলন। নৌকা ভরে ভরে নারী-পুরুষ-শিশু আশপাশের গ্রাম থেকে এসে নামছেন ফতেপুরে মহাসড়কের কাছে ছোট্ট অস্থায়ী ঘাটে। তাঁদের বাড়ি পাশের গ্রাম বাটপাড়া, মাইজপাড়া, দত্তপাড়া কিংবা মাঝেরটোলে।
কেউ আসছেন ত্রাণের আশায়, কেউ বা নিত্যপ্রয়োজনীয় সদাই কিনতে। দুর্গত অনেকের আশা, মহাসড়কে দাঁড়ালে হাত বাড়ালেই হয়তো মিলবে ত্রাণ।
গ্রামে বন্যার পানি ঢোকার পর থেকেই শংকর দাস ও বাবুলি সরকারের মনের আকাশে মেঘ। সড়কের পাশে এক টংঘরে তাঁদের এখনকার ঠিকানা। শংকর আর বাবুলির ত্রাণের দিকে নেই তেমন নজর। ডুবে থাকা প্রিয় গ্রামের দিকে দু'জনার অপলক চোখ। অভিব্যক্তিই বলে দেয়, বিস্তর কষ্ট লেখা তাঁদের মুখের পরতে পরতে। ফতেপুর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে তাঁরা যাতায়াত করতেন গ্রামে। এখন সেই গ্রামীণ সড়কে হাঁটুপানি। কিছু জায়গায় সড়কের অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলেও এরই মধ্যে পিচ উঠে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে লাল ইটের কংকালটা। কারও কারও ঘরের টিনের চালা বানের পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে জানান দিচ্ছে, এটাই ভিটেমাটি।
পাশেই করিশ নদ। মৃদু বাতাসে নদীতে টেউয়ের ঝাঁপটা। এর মধ্যেই কেউ আবার মাছ ধরায় ব্যস্ততা। আশপাশের সব খামার তলিয়ে যাওয়ায় জেলের জালে মাছও মিলছে বেশ। সেখানে বাবুলি সরকারের সঙ্গে কথা। কী ভাবছেন- এমন প্রশ্নে তাঁর সোজা জবাব, 'জীবন নিয়ে ভাবছি। সামনে কী হবে! শুধু কি আমাদের গ্রামের সবার কথাই ভাবছি! এক মাস আগের বন্যা ক্ষেতের সব কেড়ে নিল। এবার বসতভিটা। কারও ঘরের মাটি পর্যন্ত নেই।' সংবাদকর্মী বুঝতে পেরে নৌকা থেকে তেড়েফুঁড়ে এলো তরুণ সরকার। স্থানীয় হরিপুর হাই স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে এই কিশোর। তরুণ বলছিল, 'সাত বিঘা জমিতে ধান ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বন্যা ধান নিল। এবার ঘরে থাকার জো নেই।' এলাকার আরও দুর্গত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরপর তিন বন্যায় এই জনপদ বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। ধান হারিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই স্মরণকালের বন্যায় সর্বস্বান্ত তাঁরা। এ যেন ক্ষতের ওপর বিষফোড়া।
বাটপাড়া গ্রামের বদরুল ইসলাম বললেন, 'পুরো গ্রামে যে কয়েকটি উঁচু ঘর আছে, আমার একটি। বন্যাদুর্গত ছয়টি পরিবার আমার বাড়িতে এখনও আশ্রয় নিয়েছে।' গোবিন্দ সরকার নামের আরেকজন বললেন, '১২ বিঘা জমির ধান হারানোর পর এখন গেল ঘর। আগুনে পুড়লেও তো কিছু থাকে। এবার এর চেয়ে খারাপ অবস্থা।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেটের উপপরিচালক কাজী মজিবুর রহমান বলেন, সিলেট অঞ্চলে এ বছর অল্প সময়ের মধ্যে তিনটি বন্যা হয়েছে। প্রথম বন্যা শুরু হয় ৩১ মার্চ, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তা ছিল। দ্বিতীয় বন্যা ১০ মে শুরু হয়ে ছিল ২২ মে পর্যন্ত। ভয়াবহ তৃতীয় বন্যাটি এখন চলছে। প্রথম বন্যায় বোরোর কুশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দ্বিতীয় বন্যায় পাকা বোরো অনেকে ঘরে তুলতে পারেননি। ওই বন্যায় আউশের চারা ক্ষেতেরও ক্ষতি হয়। এবার গেছে আউশের ক্ষেত। তিনি বলেন, সিলেটের আট হাজার কৃষকের জন্য বরাদ্দ এসেছে। এর মধ্যে ফসলের বীজ ও সার রয়েছে। আরেকটু পানি কমলে প্রণোদনা দেওয়া হবে।
জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম বলেন, উপজেলার সব পয়েন্টে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। অনেকে ত্রাণ পেয়েও নানা অভিযোগ করছে। এ ছাড়া এলাকার সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করতে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সমন্বয়ে কাজ চলছে। দু-চার দিনের মধ্যে এটা পেয়ে যাব।
সিলেটের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন জন্মেজয় দত্ত বলেন, কিছু জায়গায় জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়া রোগী আছে। তবে এখনই এটাকে প্রাদুর্ভাব বলা যাবে না। পানি নেমে যাওয়ার পর আগামী এক সপ্তাহ চ্যালেঞ্জিং। এ সময় রোগশোক ছড়ানোর আদর্শ সময়। এটা প্রতিরোধে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। বিশুদ্ধ পানির ট্যাবলেট সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে রাস্তাঘাট খারাপ থাকায় আমাদের মেডিকেল টিম সব জায়গায় যেতে পারছে না। সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম অনেক দুর্গম এলাকায় যাচ্ছে।
ত্রাণের জন্য হাহাকার :সিলেটের জৈন্তার ছয়টি ইউনিয়নের সব কয়েকটি গ্রাম এখনও পানির নিচে। দুর্গত মানুষ এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকের অভিযোগ, তাঁদের কাছে ত্রাণ এখনও পৌঁছেনি।
ফরফরা গ্রামের বৃদ্ধ সমরতা বেগম। পরনের মোটা সুতি কাপড় পুরোটাই ভেজা। মহাসড়কে বসে কাঁদতে কাঁদতে সমরতা বলছিলেন, 'ত্রাণ দেওয়ার খবর শুনে পানি ডিঙিয়ে অনেক দূর থেকে এসেছি। তবে পৌঁছার আগেই ত্রাণের গাড়ি চলে গেছে। স্বামী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে কী খাব- এটা নিয়েই চিন্তাই পড়েছি।'
ওই এলাকা দিয়ে কোনো গাড়ি যেতে দেখলেই ত্রাণপ্রত্যাশী একেকজন মানুষ হাত নেড়ে থামানোর চেষ্টা করেন। সংবাদকর্মীদের যানবাহন দেখলেও কেউ কেউ বিশ্বাস করছিলেন, তাঁরা ত্রাণ নিয়ে এসেছেন। ত্রাণের দাবিদার হিসেবে তাঁদের নাম লেখার অনুরোধ করেন অনেকে। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো কোনো জায়গায় ত্রাণ দিতে দেখা গেছে। সরকারিভাবেও ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম।
বাড়ছে পানিবাহিত রোগ :দুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটের কারণে নানা ধরনের রোগও দেখা দিচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকেই জৈন্তা এলাকার মাওলানা আবদুল লতিফ জুলেখা গার্লস হাই স্কুলে মেডিকেল ক্যাম্প তৈরি করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের লম্বা লাইন। রাহেলা বেগম এসেছেন তাঁর চার মেয়েকে নিয়ে; এর মধ্যে ১১ মাসের ছোট্ট মেয়ে ফারিয়া আনজুম আরফা কোলে। ১৫ বছরের সুমনা ও সাত বছরের হাছানা মায়ের পাশেই লাইনে দাঁড়িয়ে। এ ছাড়া রাহেলা একমাত্র বিবাহিত মেয়ে রুমানা (১৯) মায়ের সঙ্গে রয়েছেন। রুমানার কোলে তাঁর সাত মাসের ছেলে শাওন। রাহেলা বললেন, 'দুই মেয়ের জ্বর। একজনের পেটের পীড়া। নাতিরও সর্দি-কাশি ও জ্বর।' রাহেলার স্বামীর মাছের খামার ছিল। বন্যায় সব মাছ ভেসে গেছে। এখন সংসারের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে বাসার প্রায় সবাই নানা রোগে ভুগছে।
ইয়াসমিন নামের আরেক নারী এসেছেন ৩৫ দিনের সন্তান সাফি ইসলামকে নিয়ে। সাফির জ্বর, সঙ্গে পাতলা পায়খানা। বিজিবির মেডিকেল ক্যাম্পের চিকিৎসক মেজর মো. তানভীর খান বলেন, সাধারণত দুর্গত এলাকায় পানি কমতে শুরু করলে পানিবাহিত রোগ দেখা দেয়। এখন বেশি পাচ্ছি চর্মরোগ, ডায়াবেটিস ও হাড়ব্যথার রোগী। পানিবাহিত রোগের মধ্যে জন্ডিস ও ডায়রিয়ার রোগীও আসছে। আগামী কয়েক দিনে এ ধরনের রোগী আরও বাড়তে পারে।
ভেসে আসছে মরা গৃহপালিত পশু-পাখি :সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকার বিভিন্ন জায়গায় মরা গরু, পশু-পাখি ভেসে আসছে। বন্যায় মানুষের পাশাপাশি গৃহপালিত পশুও অনেক সংকটে রয়েছে। অনেকে গরু-ছাগল উঁচু ভবনের ছাদ ও মহাসড়কের যে অংশ পানিতে ডোবেনি, সেখানে নিয়ে রেখেছেন। জৈন্তার দরবস্ত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাহারুল আলম বলেন, এলাকার ১০ শতাংশ মানুষও ধান ঘরে তুলতে পারেনি। যদিও এখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল। সরকারিভাবে যে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত। আবার বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসন নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। পানি চলে গেলেও অনেকের ঘরই বসবাসের উপযোগী থাকবে না। সরকার যদি সহযোগিতা করে ঘর নতুনভাবে তৈরি করে দেয়, তাহলেও হয়তো মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: